প্রথম রাজধানী চুয়াডাঙ্গা থেকে বর্তমান রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন নেই
চুয়াডাঙ্গা পতিনিধিঃ
বায়েজিদ জোয়ার্দার
বাংলাদেশের যতগুলো জেলার মাটি স্পর্শ করে রেললাইন রয়েছে, সবগুলো জেলা সদরের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সরাসরি সংযোগ রক্ষাকারী এক বা একাধিক ট্রেন চালু রয়েছে। কেবলমাত্র বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাজধানী চুয়াডাঙ্গা থেকে সরাসরি ঢাকাগামী আলাদা কোনো ট্রেন চালু করা হয়নি বিগত ৫০ বছরেও।
দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে রাজধানীর যোগাযোগ রক্ষাকারী সকল ট্রেন এখন পর্যন্ত যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করে। ট্রেনগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে সেতুর দুই পাড়ের স্টেশনে থামতে হয়। তার মানে দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকায় চলাচলকারী প্রত্যেক ট্রেন সিরাজগঞ্জে যাত্রাবিরতি করে। সিরাজগঞ্জবাসী চাইলে যে কোনো ট্রেনেই যাতায়াত করতে পারেন এবং করেনও। তারপরও ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ বিশেষ ট্রেন চালু রয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের প্রথম রেলস্টেশন চুয়াডাঙ্গা হওয়া সত্ত্বেও সেখান থেকে বা তার পূর্ববর্তী সীমান্ত শহর দর্শনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত পৃথক কোনো ট্রেন অদ্যাবধি চালু করা হয়নি। এই লজ্জা কার?!? এর দায়ভার কার?
ঢাকা থেকে বেনাপোল হয়ে কলকাতা যেতে যত সময় লাগে, তারচেয়ে অনেক কম সময়ে দর্শনা হয়ে কলকাতায় পৌঁছানো সম্ভব। অথচ দেখুন- বেনাপোল থেকে ঢাকা পর্যন্ত ট্রেন চালু আছে, কিন্তু ঢাকা থেকে দর্শনা পর্যন্ত কোনো ট্রেন চালু করা হয়নি!
দর্শনা বাংলাদেশের একমাত্র শিল্প-শহর, যেখানে দুই-দুইটি রেলস্টেশন আছে। শুধু তাই নয়, দর্শনা আন্তর্জাতিক রেল-সীমান্ত এবং যাত্রা শুরুর স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করার মতো দরকারি অবকাঠামো সেখানে ব্রিটিশ আমল থেকেই বিদ্যমান। কেবলমাত্র উদ্যোগের অভাবে রেলওয়ের এতো বি-শা-ল অবকাঠামো পরিত্যক্ত অবস্থায় ক্রমশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে…। দর্শনা থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত ‘রায়টা’ নামক যে ট্রেনটি দীর্ঘকাল যাত্রীদের সেবা দিয়ে এসেছে, অজ্ঞাত কারণে সেটাও কয়েক বছর আগে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের দুইটি দীর্ঘতম সেতু হচ্ছে যমুনা (বঙ্গবন্ধু) সেতু ও পদ্মা সেতু। এই দুইটি সেতু চালু হওয়ার পর দেশের অধিকাংশ জেলা থেকে রাজধানী ঢাকায় যাতায়াতের ঝাক্কি-ঝামেলা কমেছে। কিন্তু এই দুইটি সেতু চালু হওয়ার পরও দেশের উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণবঙ্গের যে তিনটি জেলাবাসী বিন্দুমাত্র লাভবান হননি (মোট দূরত্ব কমেনি বা যাতায়াতের সময় বাঁচেনি), সেই তিনটি দুর্ভাগা জেলা হলো মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ। এই তিন জেলাবাসীর চলাচলের কষ্ট কিছুটা লাঘবের জন্য সান্ত্বনাস্বরূপ হলেও সরাসরি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষাকারী দুইটি (নিদেনপক্ষে একটি) ট্রেন চালু করা দরকার। কিন্তু সেদিকে কারো ন্যূনতম সুদৃষ্টি নেই।
কিছুদিন আগে পর্যন্ত রেলপথ মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব ছিলেন চুয়াডাঙ্গা জেলার তিতুদহ-বেগমপুর এলাকার কৃতীসন্তান। বর্তমানে যমুনা সেতুর পাশ দিয়ে আলাদাভাবে যে রেল সেতু নির্মিত হচ্ছে, সেই প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী Ahsan Jabir চুয়াডাঙ্গার কৃতীসন্তান। সমগ্র রেলওয়ের টিকেটিং ব্যবস্থা সুনিপুণ হাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চুয়াডাঙ্গা জেলার আরেক কৃতীসন্তান Nahid Hasan Khan Nipu। কিন্তু তারপরও চুয়াডাঙ্গাবাসীর আশা তথা দাবি পূরণ হচ্ছে না।
অনেকেরই হয়ত জানা নেই যে, চুয়াডাঙ্গার কৃতীসন্তান এম. এ. বারী (২৪.৫.১৯০১- ২৮. ১০. ১৯৭১) ছিলেন অবিভক্ত নদীয়ার প্রথম মুসলমান প্রকৌশলী- যিনি ১৯৪৭ সালে দেশভাগেরও আগে পূর্ববঙ্গ রেলওয়ে-তে যোগ দিয়ে পর্যায়ক্রমে জেনারেল ম্যানেজার (মানে পূর্ববঙ্গ বা বর্তমান বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের রেলওয়ের প্রধান) পদে সুদীর্ঘকাল সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। অথচ তাঁর নিজ জেলা (তৎকালীন মহকুমা) বর্তমান রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে কতটা অবহেলিত ও উপেক্ষিত!
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বর্তমানে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর জেলার সদরসহ বিভিন্ন প্রান্তিক জনপদ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ২৫০টি কোচ/বাস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় এবং সমপরিমাণ পরিবহন ঢাকা থেকে যাত্রী বয়ে নিয়ে আসে। এই ৫০০+ ট্রিপ-এ প্রতিদিন কমপক্ষে ২০,০০০+ মানুষ যাওয়া-আসা করেন। এঁদের চলাচলের কষ্ট লাঘব তথা সুবিধার জন্য অন্তত একটি ট্রেন বরাদ্দ করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব নয় কি?
বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যদি চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহ জেলাবাসীর যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় একযোগে দশটি ট্রেনও চালু করে, তবু যাত্রীর অভাব হবে না বা একটি আসনও খালি থাকবে না। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষামূলকভাবে একযোগে দশটি ট্রেন (দুই ঘণ্টা পরপর) চালু করে দেখতে পারেন…! অবহেলিত এই জনপদের শিক্ষিত তরুণেরা কারো দয়ায় চাকরি চায় না, তবে তাঁরা নিজ নিজ যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি খুঁজে নেওয়ার জন্য অপেক্ষাকৃত কম খরচে ঢাকায় যাতায়াতের সুযোগ চায়।
আমরা জীবননগর, দর্শনা, দামুড়হুদা, মুজিবনগর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, আলমডাঙ্গা, কালীগঞ্জ, মহেশপুর, কোর্টচাঁদপুর, হরিণাকুন্ডু ও ঝিনাইদহবাসী রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দিনে-রাতে যোগাযোগ রক্ষাকারী একাধিক ট্রেন চাই। তবে ট্রেন চালু করা সম্ভব হলে সেই ট্রেনের নাম যদি ‘মুজিবনগর এক্সপ্রেস’ অথবা ‘দর্শনা এক্সপ্রেস’ অথবা ‘মাথাভাঙ্গা এক্সপ্রেস’ অথবা ‘প্রথম রাজধানী এক্সপ্রেস’ অথবা ‘নবগঙ্গা এক্সপ্রেস’ অথবা ‘এম. এ. বারী এক্সপ্রেস’, ’ রাখা হয়, তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। যে নামেই ডাকুন না কেন, আমরা প্রথম রাজধানীর সঙ্গে রাজধানী ঢাকার মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ রক্ষাকারী নিজস্ব ট্রেন চাই- এটাই আমাদের শেষ কথা।
Leave a Reply